Hesperian Health Guides

ডায়াবেটিস

এই অধ্যায়ে

ডায়াবেটিস কী?

আমরা যখন খাদ্য হজম করি তখন তা আমাদের রক্তে চিনি পৌঁছে দেয়। এই চিনিকে গ্লুকোজ বলা হয় এবং আমাদের দেহ এটিকে ব্যবহার করে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে। মিষ্টি জিনিস গ্লুকোজ-এ পরিণত হয় এবং অন্যান্য খাদ্যও তাই হয়, বিশেষ করে শ্বেতসারযুক্ত খাদ্য যেমন ভাত, ভূট্টা, মিষ্টি আলু, আলু, এবং রুটি বা গম থেকে তৈরী করা অন্যান্য খাদ্য।

ডায়াবেটিস মানে হলো আপনার রক্তে অনেক বেশী চিনি থাকা। ডায়াবেটিস হলে আমাদেরকে শক্তি দেয়ার পরিবর্তে চিনিগুলো রক্তের মধ্যে জমা হতে থাকে এবং দেহের ক্ষতি করে।

NWTND Diab Page 1-1.png এক টুকরো সাদা রুটি মুখে নিন। চেখে দেখুন এটি কতটা মিষ্টি?

সচরাচর হওয়া ডায়াবেটিসের ধরনটিকে ধরন ২ ডায়াবেটিস বলা হয়। এই ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণতঃ যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়া, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য—বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত ও মোড়কজাত খাদ্য—গ্রহণ করা এবং অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও অসমতার কারণে হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস একটি ‘দীর্ঘস্থায়ী’ রোগ, যার মানে হলো যে এর মাত্রা বাড়তে পারে বা কমতে পারে, কিন্তু এটি কখনোই সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হবে না।

ডায়াবেটিস নিয়ে সুস্বাস্থ্যে থাকার জন্য আপনার রক্তে থাকা চিনির পরিমাণ (মাত্রা) নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস বিপজ্জনক কারণ রক্তে উচ্চ মাত্রার চিনি অন্ধত্ব, অঙ্গহানী, যৌণসঙ্গম করার সামর্থ্য হারানো, স্ট্রোক, বা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আপনি যদি চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা বজায় রাখতে পারেন তবে এই সমস্যাগুলোর বেশীরভাগই এড়ানো সম্ভব, এবং আপনি একটি কর্মময় ও স্বাস্থ্যকর জীবন পেতে পারেন। এটিকে বলা হয় ডায়াবেটিস ‘সামলানো’।

ডায়াবেটিস নিয়ে কি আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারেন?

ঔষধ ও চিকিৎসা সেবা ডায়াবেটিস নিরাময় করতে পারে না। কিন্তু মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে সুস্বাস্থ্যে থাকতে পারে যদি রোগটি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকে ও রোগটি নিয়ন্ত্রণের ব্যপারে তারা যত্নবান হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, মাঢ়ীর ও দাঁত পরিষ্কার রাখা, পায়ের যত্ন নেয়া, দুঃশ্চিন্তা না করা, এবং বেশী করে বিশ্রাম নেয়া। এগুলোর সাথে প্রয়োজনবোধে ঔষধও সেবন করতে হবে।

মানুষকে সহায়তা দলে একত্রিত করে তাদের অসুস্থ্যতা সম্পর্কে জানতে ও নিজেরাই নিজেদের যত্ন নেয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরাও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করতে পারে।
এক দল লোক আলাপ-আলোচনা করছে
আমার যে স্বাস্থ্যকর খাবার প্রয়োজন তা আমার পরিবারকে বলা আমার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু তারা এখন দেখতে পাচ্ছে আমি কেমন ভাল অনূভব করছি এবং তারা এটাও বুঝেছে যে আমরা যা খাই তা পরিবর্তন করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের উন্নতি করা সম্ভব।

ডায়াবেটিস এর লক্ষণ

ডায়াবেটিস-এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রায়শই বুঝতে পারা কঠিন। কখনও কখনও আদৌ কোন লক্ষণই দেখা যায় না। অনেক মানুষ নিজের অজান্তেই ডায়াবেটিস নিয়ে বসবাস করছে।

ডায়াবেটিস হতে পারে এমন কিছু লক্ষণ
  • পিপাসা পাওয়া
  • ঘন ঘন মূত্রত্যাগ
  • দৃষ্টি ঘোলা হওয়া
  • কর্মশক্তির অভাব বা সহজেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া
  • ক্ষতস্থান ধীরে নিরাময় হওয়া
  • পায়ের পাতায় অবশ অনুভূত হওয়া
  • নারীদের ক্ষেত্রে পুনঃপুনঃ ঘটা ছত্রাক (ক্যানডিডা) জনিত যোনিপথের প্রদাহ


এই লক্ষণগুলো আরও অনেক স্বাস্থ্য সমস্যাতেই দেখা যায়, তাই শুধুমাত্র এই লক্ষণগুলো দেখেই একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে কিনা তা আপনি বলতে পারেন না। নিশ্চিতভাবে জানতে রক্ত পরীক্ষা করুন।

একজন অসুস্থ্য দেখাচ্ছে এমন নারীর কোলে একটি শিশু্ ওঠার চেষ্টা করছে।
বিপদ চিহ্ন

রক্তে চিনি যখন অতিমাত্রায় বেড়ে যায়, তখন নীচের লক্ষণগুলো দেখা দেয়:

  • প্রচণ্ড তৃষ্ণা পাওয়া
  • অতিরিক্ত দুর্বলতা এবং ঘুমঘুম ভাব বা বিভ্রান্তি
  • ক্ষুধা পাওয়া
  • যথেষ্ট খাদ্য গ্রহণ করার পরও ওজন কমে যাওয়া


উপরোক্ত এই সমস্ত বিপদচিহ্নযুক্ত একজন ব্যক্তিকে দ্রুত পরীক্ষা ও চিকিৎসা করাতে হবে। যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে একজন ব্যক্তি রক্তে উচ্চ মাত্রার চিনির কারণে মৃত্যুবরণ করতে পারে। রক্তে উচ্চ মাত্রার চিনি (হাইপারগ্লিসেমিয়া) দেখুন।

অনিয়ন্ত্রীত ডায়াবেটিস থেকে সৃষ্ট সমস্যা

মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর যদি ডায়াবেটিসের চিকিৎসা না করা হয় তবে উচ্চ মাত্রার চিনি অঙ্গহানী, স্নায়ুহানী, এবং রক্ত নালীর ক্ষতি করতে পারে। এর ফলে দেহে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে যা থেকে চিরস্থায়ী ক্ষতি বা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

একজন নারী
স্ট্রোক (পক্ষাঘাত)
অন্ধত্ব
মাঢ়ীর সংক্রমণ, দাঁত পড়ে যাওয়া
হৃদরোগ
কিড্‌নি নষ্ট হওয়া
যৌনবাসনা হ্রাস পাওয়া, যন্ত্রণাময় যৌনসঙ্গম
পুরুষদের ক্ষেত্রে: যৌনাঙ্গ ঋজু হয় না
নারীদের ক্ষেত্রে: যৌনাঙ্গে ইস্ট সংক্রামণ
নিরাময় না হওয়া ত্বকের সংক্রামণ, আলসার
অবশভাব বা ব্যথা (নিউরোপ্যাথী)

রক্তে অতি পরিমাণ চিনি স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। উচ্চ মাত্রার কারণে অনেক লোকই তাদের পায়ে ব্যথা অনুভব করে বা তাদের পা অবশ হয়ে যায়। উচ্চ মাত্রা রক্ত সঞ্চালনেও সমস্যা সৃষ্টি করে যা ত্বকের উপর ক্ষত শুকাতে বিলম্ব ঘটায়। ব্যক্তিটি খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রক্তে উচ্চ মাত্রার চিনি চোখ ও কিড্‌নির ক্ষতি করতে পারে, যেমন, হয় এগুলো ভালভাবে কাজ করা বন্ধ করতে পারে বা এগুলো আদৌ কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।

এই সকল সমস্যাই নিম্নে উল্লেখিত কারণে আরও খারাপ হতে পারে:

উচ্চ রক্ত চাপ আপনার হৃদপিণ্ডের কাজ ও রক্ত সঞ্চালন করা কঠিন করে তোলে, যার ফলে অন্যান্য অঙ্গগুলোরও ক্ষতি হয়, এবং এর ফলে রক্তে চিনির মাত্রাকে অনেক উচ্চ করে তোলে। ধূমপানের কারণে উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয় এবং খুব সহজেই স্ট্রোক বা হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা ঘটায় (হৃদরোগ দেখুন, সংকলন চলছে)। ডায়াবেটিসযুক্ত কোন ব্যক্তির জন্য ধূমপান বন্ধ করা এবং তার রক্তচাপ হ্রাস করা গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু ডায়াবেটিস হলেই এই সমস্যাগুলো দেখা দেবার কোন কারণ নেই। স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, যথেষ্ট পরিমাণ শরীরচর্চা, এবং দুশ্চিন্তা হ্রাস করার মাধ্যমে আপনি আপনার রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। আপনার পা, দাঁত, এবং মাঢ়ীর যত্ন নেবার কয়েকটি উপায় শিখে নেওয়ার মাধ্যমে মুখ ও পায়ের সংক্রামণগুলো খুব সহজেই রোধ করা যায়।

ডায়াবেটিসের ধরন

তিন ধরনের ডায়াবেটিস আছে:

ধরন ১ ডায়াবেটিস সাধারণতঃ তরুণ ব্যক্তিদের হয় এবং খুব দ্রুত এটি দেখা দেয়। ধরন ১ ডায়াবেটিসের কারণ এখনও জানা জায়নি। এটি ধরন ২ এর চেয়ে অনেক কম দেখা যায়। (পৃষ্ঠা ৫ দেখুন)

একটি শিশু বা তরুণ যুবক/যুবতী যদি বেশীরভাগ সময় তৃষ্ণার্ত হয়, দুর্বল অনুভব করে, বা ভাল খাদ্য গ্রহণ সত্ত্বেও ওজন হারায়, তবে তাকে ততক্ষণাৎ পরীক্ষা করুন। যদি তার ধরন ১ ডায়াবেটিস থাকে তবে তার দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।

ধরন ১ ডায়াবেটিস মানে হলো ব্যক্তিটি খুব ভালভাবে চিনি প্রক্রিয়াজাত করতে পারছে না। তাকে ভালভাবে বাঁচতে হলে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইন্সুলিন নামক একটি ঔষধ শরীরে প্রবেশ করাতে হবে। তার ইন্সুলিন ও যন্ত্রপাতীর প্রয়োজন হবে, এবং এগুলো ব্যবহারের জন্য শিক্ষা ও সহায়তারও প্রয়োজন হবে। .
একজন লোক নিজেই নিজের পেটে ইন্সুলিন নিচ্ছে।
ইন্সুলিন প্রবেশ করানোর সাধারণ জায়গা হলো পেট।

ধরন ২ ডায়াবেটিস সাধারণতঃ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই দেখা দেয় এবং খুব ধীরে আসে, কিন্তু তরুণ ব্যক্তিদেরও এটি হতে পারে। ডায়াবেটিসযুক্ত বেশীরভাগ ব্যক্তিই ধরন ২-এ আক্রান্ত এবং এই অধ্যায়ে বিশেষত সেবিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে।

যারা বেশী পরিমাণ কারখানায় প্রক্রিয়াজাত, শর্করা, এবং শ্বেতসার জাতীয় খাবার খায় এবং সামান্য শারীরিক পরিশ্রম করে তারা সাধারণতঃ ধরন ২ ডায়াবেটিসে ভোগে। আর যাদের মোটা পেট তারাও ভোগে, বিশেষ করে তাদের পরিবারে যদি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি থাকে, বা দীর্ঘমেয়াদে তাদের না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।

ধরন ২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা শুরু হয় স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা, শারীরিক পরিশ্রম বৃদ্ধি, এবং মানসিক চাপ হ্রাস করার মাধ্যমে। ধরন ২ যুক্ত ব্যক্তিরা ঔষধ বা বনৌষধী ব্যবহার করে উপকার পেতে পারে।
২জন নারী একটি সাইনের দিকে তাকিয়ে আছে।
ডায়াবেটিস
সম্পর্কে চিন্তিত?
আজ রাতে স্বাস্থ্য কর্মীদের আলোচনায় যোগ দিন।
কমিউনিটি ক্লিনিক

গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস হলো ধরন ২ জাতীয় ডায়াবেটিস যা কোন কোন গর্ভবতী নারীর হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসযুক্ত একজন নারীর রক্তে চিনি উচ্চমাত্রায় থাকে এবং তাই তার গর্ভের শিশুটির রক্তেও চিনি উচ্চমাত্রায় থাকবে। জন্মদানের পর রক্তে তার চিনির মাত্রা স্বাভাবিকে ফিরে আসতে পারে বা নারীটির ধরন ২ ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসযুক্ত অন্যান্যদের সমস্যাযুক্ত গর্ভবস্থা দেখা দিতে পারে এবং তাদের শিশুরা জঠরের মধ্যে অতিরিক্ত বড় আকার ধারণ করে গর্ভদান কঠিন করে তুলতে পারে। ডায়াবেটিসযুক্ত একজন নারীকে হাসপাতালে প্রসব করা উচিত যদি তার অস্ত্রপচার করে জন্মদান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। শিশুটি হয়তো নিম্ন বা উচ্চ মাত্রার চিনি বা শ্বাসজনিত সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বেশীরভাগই স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ ও মাঝেমাঝে ঔষধের সাহায্যে বা বনৌষধীর সাহায্যে সামলানো যায়।

ডায়াবেটিসযুক্ত বেশীরভাগ নারীই স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্মদান করতে পারে।
NWTND Diab Page 5-2.png


এই পাতাটি হালনাগাদ করা হয়েছে: ২৫ এপ্রিল ২০২৪